মহানগর ডেস্ক: আজ আপনাদের এমন এক মহিলার সাহসিকতার গল্প বলতে চলেছি যা পড়লে আপনার চোখে জল এলেও মুখে হাসি ফুটবে। এককথায় মনে জোর থাকার জন্য এই অসাধ্য সাধন করা সম্ভব হয়েছে । বছর ২৪ এর এক গৃহবধূ ক্যান্সার নিরাময়ের জন্য চিকিৎসা করতে ও তার সাথে নিজ প্রথম বাচ্চাকে সুস্থ সবল ভাবে জন্ম দেওয়ার জন্য উত্তরবঙ্গ থেকে কলকাতায় এসেছিলেন ।
মহিলার নাম মলি। জানা যাচ্ছে এই মহিলার জেদের কাছে SSKM এর চিকিৎসারাও হার মেনেছিল। চিকিৎসকদের দাবি এই মহিলা অন্তঃসত্ত্বা ছিল, এই অবস্থায় কার্যত ঝুঁকিপূর্ণ পরিস্থিতির মধ্যে দিয়েই স্তন ক্যান্সারের চিকিৎসা শুরু করেছিলেন চিকিৎসকরা ।
স্বামীর নাম মহম্মদ আজাদ শেখ, পেশায় দোকানে দোকানে ওষুধ পৌছে দিতেন, পুরাতন মালদহের বাসিন্দা। তিনি জানান গত বছর মে মাসে তার স্ত্রী মলি খাতুন অন্তঃসত্ত্বা সেটা তার পরিবার জানতে পারে। এই খুশির মধ্যেই মলি একদিন খেয়াল করলো তাঁর বাঁদিকের স্তনে মাংসপিন্ড গুটলি হয়ে আছে বলে অনুভব করে, দেরি না করে স্থানীয় স্ত্রীরোগ চিকিৎসকের কাছে সেটি যখন গিয়ে দেখান, চিকিৎসক কয়েকটা টেস্ট করার পরামর্শ দেন । টেস্টের রিপোর্ট এলে জানা যায় মলির স্তন ক্যানসার হয়েছে। প্রথমে সে এটি শুনে ভেঙে পড়ে। কারণ চিকিৎসক বলেছিল ক্যান্সারের চিকিৎসা শুরু করতে গেলে মলি কে গর্ভপাত করতে হবে। কিন্তু মলি নাছোড়বান্দা। মলির ইচ্ছে ছিল প্রথম সন্তান সে গর্ভপাত করবেনা । কি করবেন এই দম্পতি বুঝতে পারছিলেন না। একদিকে কান্সার অন্যদিকে গর্ভে সন্তান এই দুই বিষয় নিয়ে বেশকিছুদিন টানাপোড়েনের মধ্যে দিয়ে তাদের দিন কাটছিল । আজাদ আরও বলেন যে, ‘‘ আমরা আরও ডাক্তার দেখালাম, কিন্তু সব ডাক্তাররাই একই কথা বলছিলেন। কিন্তু আমরা রাজি ছিলাম না। এই ভাবে প্রায় তিন মাস কেটে যায়, খোঁজখবর জারি রেখেছিলাম । বিভিন্ন জায়গায় খোঁজখবর নিয়ে তারপর কলকাতায় আসার সিদ্ধান্ত নি আমরা দুজন।‘
দম্পতী জানান, গত বছরের জুলাই মাসে কলকাতার একটি বেসরকারি হাসপাতালে তাঁরা এসে যোগাযোগ করেন, এখানেই চিকিৎসক কৌশিক চট্টোপাধ্যায়ের সঙ্গে আলাপ হয় । চিকিৎসক যখন মলির সঙ্গে কথাবত্রা বলেন তাঁর শরীরের অবস্থা সম্পর্কে,তারপর চিকিৎসক বুঝতে পারেন যে এই বিষয়টি এতটাও সহজতর ব্যপার নয় যথেষ্ট ঝুঁকিপুর্ন কাজ । চিকিৎসক মলিকে SSKM হাসপাতালে স্থানান্তরিত করে। sskm -এ চিকিৎসক দীপ্তেন্দ্রর এবং চিকিৎসক কৌশিকের অধীনে চিকিৎসা শুরু হয়। চকিতসায় যাতে নিপুন ভাবে সফলতা আসে, এন শিশু ও মা এর কনরকম ক্ষতি না হয় তাঁর জন্য স্ত্রীরোগ বিভাগের প্রধান চিকিৎসক সুভাষ বিশ্বাস এবং নিয়োনেটোলজির প্রধান চিকিৎসক সুচন্দ্রা মুখোপাধ্যায়কে নিয়ে মেডিক্যাল বোর্ড গঠন করা হয়। চিকিৎসার ব্যপারে চিকিৎসক কৌশিক জানিয়েছেন, গর্ভাবস্থার প্রথম তিন মাসের মধ্যে ভ্রূণের অঙ্গপ্রত্যঙ্গ তৈরি হয়ে যায়।আর যখন মলির দ্বিতীয় ট্রাইমেস্টার চলছিল তখন মলি চিকিৎসার জন্য তাঁদের কাছে এসেছিলেন ।চিকিৎসক বলেন, ‘‘ওই সময়কালে কেমো দিলে গর্ভস্থ সন্তানের ক্ষতি হওয়ার আশঙ্কা তেমন নেই। তাই তাড়াহুড়ো করে চকিসকরা নিজেদের মধ্যে কথাবত্রা বলে কেমো চালু করা হয়।
চিকিৎসা চলবে বহুদিন, এই কথা ভাবনাচিন্তা করেই এই দম্পতী চিকিৎসা চলাকালীন হাসপাতালের আশপাশে ঘর ভাড়া পাওয়া যাবে কিনা তাঁর সন্ধান চালায়, পেয়েও যায়, তারপর শুরু হয়ে যায় চিকিৎসা । চিকিৎসকেরা বলেন, গত বছরের অক্টোবরের মাঝামাঝি পরীক্ষা করে দেখা যায় যে মলির গর্ভস্থ সন্তানের কিডনিতে একটু সমস্যা দেখা দিয়েছে, তৎক্ষনাত সিজ়ারের মাধ্যমে বাচ্চার জন্ম হবে বলে সিদ্ধান্ত নেন চিকিৎসকেরা। চিকিৎসকদের পরামর্শ মতো কেমো বন্ধ করা হয়। এতক্ষন ধরে যেই প্রশ্ন আপনাদের মনে জাগছে যে শিশুটি সুস্থসবল অবস্থায় আছে কিনা?তাহলে বলি ৩মাস হতে যায় মলি ও আজাদের সন্তান সুস্থ ভাবে জন্ম নেয়। গতবছর নভেম্বরে তাঁদের শত বাঁধা অতিক্রম করার পর খুশীর মুখ দেখলেন এই দম্পতী, মলির স্বামী জানান, ‘জন্মের পরে নিয়োনেটাল কেয়ার ইউনিটে বাচ্চাকে কয়েক দিন রেখে সুস্থ করে ছাড়া হয়েছিল। আমাদের প্রথম সন্তানের মুখ দেখতে পাব, তা ভাবতেই পারিনি।‘ সিজ়ারের আগে থেকে শুরু করে প্রসবের পরেও প্রায় দেড় মাস কেমো বন্ধ রাখা হয়েছিল। তার ফলে মলি তাঁর সন্তানকে স্তন্যপান করাতে পেরেছে। শিশু জন্ম দেওয়ার বেশ কিছুদিন পর ফের কেমো চালু হয় মলির। চিকিৎসকরা পরামর্শ দেন যদি টিউমারের আকার না কমে তাহলে চিন্তার বিষয় হয়ে দারাবে। ফলে যখন দেখা গেলো পরীক্ষা করিয়ে স্তনে টিউমারের আকার বাড়তে থাকায় তখন অস্ত্রোপচারের সিদ্ধান্ত নেন চিকিৎসকেরা । সফল্ভাবে টিউমার বাদ দেওয়ার সাথে পিঠ থেকে মাংস নিয়ে স্তন পুনর্গঠন করে । চিকিৎসক দীপ্তেন্দ্র বলেন, ‘ক্যানসারমুক্ত করার পাশাপাশি রোগীর ইচ্ছে মতোই স্তন বাঁচানো ও মাতৃত্বের স্বাদ দুই দেওয়া সম্ভব হল। এই অস্ত্রপচার সফল ভাবে করতে পেরে বেশ ভাল লাগছে। ‘
চিকিৎসক সুভাষ বিশ্বাস বলছেন, ‘‘মা ও সন্তান, উভয়ের স্বাস্থ্যের দিকেই নজর রেখে ওষুধ দিতে হয়েছিল। কারণ, ক্যানসার আক্রান্ত ওই মায়ের কাছে মানসিক সুস্থতাই ছিল আসল। সেটা বজায় রাখতে পারার কারণেই ভাল ফল মিলেছে।’ একজন মা চাইলে নিজ সন্তানের জন্য কি না করতে পারেন আবারও গোটা দুনিয়া এর প্রমাণ দেখল। ক্যান্সারের সাথে লড়ে সন্তানকে জন্ম দিয়ে মলি আত্ম্যহারা,পাশাপাশি দম্পতীর স্বামী, দুই পরিবাররের আত্মিয়সজন এবং প্রতিবেশীরা প্রত্যেকেই খুশি। ক্যান্সার কে রীতিমত বুড়ো আঙ্গুল দেখিয়ে মনের জোড়ে ও চিকিৎসকদের চিকিৎসার সহায়তায় এই অসম্ভবকে সম্ভব করা গিয়েছে।