মহানগর ডেস্ক: পঞ্চাদশ খ্রিস্টাব্দ,দেশে তখন ঘোর ঘনঘটা। দিল্লীর মসনদ পাল্টাচ্ছে। বাংলার ললাটে তখন অশনি সংকেত। ঠিক সেই সময়, বর্ধমানের ফুলিয়া গ্রামে ভরদ্বাজ গোত্র,ব্রাক্ষ্মণ, কৃত্তিবাস ওঝা বঙ্গানুবাদ করলেন “রামায়ণ”। যেমন উনবিংশ শতকে বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় লিখলেন কৃষ্ণকান্তের উইল।
রামচরিত মানস বা মহর্ষি বাল্মীকি রচিত রামায়ণের সাথে বাঙালি সেই ভাবে কোনোদিন পরিচিত হয়নি। তাঁদের কাছে কৃত্তিবাস, বাল্মীকি সমতুল।কৃত্তিবাসী রামায়ণের দৌলতে বাল্মীকির রামের ঐশ্বরিক শক্তি বিলোপ পায়। তিনি হয়ে ওঠেন সাধারণ গেরস্থালির মানুষ।কোনো এক বাংলার গ্রামে হয়তো বা দত্ত বাড়ির ঘটনা। সেখানে রাম সূর্যবংশীয় তকমা ত্যাগ করে,হয়ে ওঠেন জমিদার বাড়ির বড়ো ছেলে। পুকুর ঘাটে জল নাইতে যাওয়ার সময় মাতৃসমা জেঠি কাকী মাসি পিসিদের আলোচনার কেন্দ্রবিন্দুতে সেই জমিদার বাড়ির বড়ো ছেলে।যে বিমাতার বিমাতৃসুলভ আচরণে স্ত্রী ও ভাই কে নিয়ে গৃহত্যাগী। গ্রামের চন্ডীমন্ডপে যখন পাঠক ঠাকুর পাঠ করতেন রাম রাবণ কথা। বাড়ির ফেরার সময় গ্রামের আলপথ দিয়ে হাঁটতে হাঁটতে থেলো হুঁকোয় টান দিয়ে মোড়ল মশাই জানান দেন, গ্রামের শেষ প্রান্তে তেপান্তরের মাঠ,আর ওইটা পেরোলেই রাবণ রাজার রাজত্ব।
রাতের পিদিমের আলোয় খেতে খেতে বাড়ির কত্তা,বড় বৌকে যখন এই গপ্প বলে।মনে মনে বড় বৌ ছবি আঁকে।তার মানে ওখানেই রয়েছে অশোক বন। সেখানে রয়েছে আমাদের দুঃখী মেয়েটি। রাতের বিছানায় শোয়ার সময়, জানলার ফাঁক দিয়ে যে বাঁশ বন দেখা যাচ্ছে,ওইটাই তো অশোক বন।একটা কান্না ভেসে আসছে,সীতা নয় তো।আহা,ওর অবস্থা তো আমাদের গ্রামের মিত্তির বাড়ির বৌয়ের মতো।বিদেশে থাকে স্বামী, শাঁখা পলা সিঁদুর নিয়ে বেঁচে আছে সোনার প্রতিমে। যেমন পলাতক সিনেমায় আংটি চাটুজ্জ্যের ভাই বসন্ত, স্ত্রী কে ফেলে চলে গিয়েছিল বহু দূর। এরকম অনেক পাশের বাড়ির ঘটনা আছে।এই বাড়ির বৌগুলোকে সবাই সীতা হিসেবে দেখে। সীতার এই করুণ পরিণতির জন্য বোধহয় দুঃখে বাঙালির ঘরের মেয়েদের নাম সীতা হয়না। বাঙালি রাখতে লজ্জা পায়।কারণ এই বাঙালির আরেক রাম তো বহু সীতাকে অগ্নিসমর্পণ হতে দেননি।
কৃত্তিবাসের পরে বহু কবি রামায়ণ লিখেছেন।তার মধ্যে উল্লেখ্য চন্দ্রাবতী দেবী।নাহ, চন্দ্রাবতী দেবী “নারীবাদ” পড়েছেন কিনা জানা নেই। কিন্তু ময়মনসিংহে চন্দ্রাবতী র স্বাভাবিক বেদনাবোধ থেকে দেখা যে রামচন্দ্র আদর্শ স্বামী নন, তিনি সীতার দুঃখের মূল কারণ,মুখে মুখে প্রচলিত। তাই বোধহয় রাম বাঙালির পূজার আসনে প্রধান জায়গা করে উঠতে পারেন নি।যেমন টি কৃষ্ণ ওরফে তাঁর ছোট রূপান্তর গোপাল জায়গা করে নিয়েছে। বাঙালির মেয়েরা প্রেম,মাতৃত্বকে গৌরব মনে করে।তাই কন্যার মাকে গর্ব করে এই বাংলায় বলতে শোনা যায়,আমি মেয়ে মা।এই আত্মগৌরব বোধহয় বাঙালির প্রেম ভাব টাকে একাত্ম করেছে,যেমন করেছে গোপাল।গোপাল ওরফে কৃষ্ণ প্রেমের প্রতীক,নিষ্ঠার প্রতীক। কিন্তু স্ত্রী ত্যাগী রাম নিষ্ঠার জায়গা হারিয়েছেন।তাই প্রেমে বেষ্টিত কোনো পুরুষ বাঙালি কলির কেষ্ট বলে,কলির রাম নয়। বাঙালি গোপালের জন্য নাড়ু বানায়, শীতের পোশাক কেনে, বিছানা পেতে শোওয়ায়,ঘরে ঘরে জন্মাষ্টমী।
কলমে : সৌরভ সিংহ
সাংবাদিক (সম্পাদক, হাওড়া প্রেস ক্লাব) ও সাহিত্যিক