মহানগর ডেস্ক : ইন্ডিয়া জোট কেন্দ্রে সরকার গড়লে তৃণমূল তার সঙ্গে থেকে কি কাজ করতে পারে সেটাই বুধবার তৃণমূল ভবন থেকে তৃণমূলের ২০২৪-এর ইস্তেহার হিসাবে প্রকাশ করলেন রাজ্যের প্রাক্তন অর্থমন্ত্রী অমিত মিত্র। তৃণমূল ভবনে এই ইস্তেহার প্রকাশ অনুষ্ঠানে উপস্থিত ছিলেন তৃণমূলের রাজ্যসভার সাংসদ ও নেতা ডেরেক ও’ব্রায়েন এবং রাজ্যের বর্তমান অর্থমন্ত্রী ও মহিলা তৃণমূলের চেয়ার পার্সন চন্দ্রিমা ভট্টাচার্য। এই ইস্তেহারের মুখবন্ধ লিখেছেন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় স্বয়ং, অমিত মিত্র এমনটাই জানান। মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় এই ইস্তেহারের মুখবন্ধে কেন্দ্রের মিথ্যা প্রতিশ্রুতি, ইচ্ছাকৃত বঞ্চনা ও মানুষকে অসম্মান করার মনোভাব স্পষ্ট ভাবে তুলে ধরেছেন। কেন্দ্র কি ভাবে মানুষের অন্ন, বস্ত্র, বাসস্থানের মতো মৌলিক অধিকার কি ভাবে ছিনিয়ে নিচ্ছে তার প্রকৃত চিত্রও মমতার লেখা নির্বাচনী ইস্তেহারের মুখবন্ধে তুলে ধরা হয়েছে। যুক্তরাষ্ট্রিয়, ধর্মনিরপেক্ষ ও গণতান্ত্রিক নীতিগুলি কেন্দ্র কি ভাবে খুন্ন করে চলেছে সেই বিষয়টিও মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় তাঁর লেখা ইস্তেহারের মুখবন্ধে তুলে ধরেছেন, তুলে ধরেছেন কেন্দ্র কি ভাবে বিরোধীদের কন্ঠরোধ করছে। মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় লিখেঋেন, “আমি দৃঢ় সংকল্প করছি যে বাংলা ও দেশের স্বার্থ বিরোধী অপশক্তিকে দৃন করব। সেই কারণেই এই ইস্তেহার তৈরী হয়েছে।”
অমিত মিত্র বলেন, মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের দুরদর্শী ভাবনার মাধ্যমে এই ইস্তেহার তৈরী হয়েছে।
দিদির শপথ অর্থাৎ ইস্তেহারের মূল বিষয়ে আসা যাক। দিদির শপথে তৃণমূল প্রতিশ্রুতি দিয়েছে কেন্দ্রে ইন্ডিয়া জোট ক্ষমতায় এলে দেশের জন্য তারা কি করতে চান।
দিদির শপথ ১০টি ভাগে বিভক্ত করা হয়েছে।
দিদির শপথ ১) বর্ধিত আয়, শ্রমিকের সহায়। এর মাধ্যমে সমস্ত জবকার্ড হোল্ডারদের গ্যারিন্টিযুক্ত ১০০ দিনের কাজ প্রদান করা হবে। দেশজুড়ে সমস্ত শ্রমিক বর্ধিত ৪০০ টাকা ন্যূনতম মজুরি পাবেন।
দিদির শপথ ২) দেশ জুড়ে বাড়ি, হবে সবারই। দেশের সকল দরিদ্র পরিবারের জন্য আবাসনননিশ্চিত করা হবে। প্রত্যেককে নিরাপদ ও পাকা বাড়ি প্রদান করা হবে।
দিদির শপথ ৩) জ্বালানির জ্বালা কমবে, দেশের জ্বালা ঘুচবে। প্রত্যেক বিপিএল পরিবারকে বছরে বিনামূল্যে ১০টি সিলিন্ডার দেওয়া হবে। যাতে তারা পরিশ্রুত রান্নার জ্বালানি পেতে পারে। এর মাধ্যমে পরিবেশ বান্ধব রন্ধন প্রক্রিয়া ব্যবস্থা চালু করা হবে।
দিদির শপথ ৪) অনেক হয়েছে শাসন, এবার দুয়ারে রেশন। প্রতি মাসে প্রত্যেক রেশন কার্ড হোল্ডারকে বিনামূল্যে পাঁচ কেজি বিনামূল্যে রপশন, চাল,গম, শস্য দেওয়া হবে। রেশন প্রাপকদের দোরগোড়ায় রেশন পৌঁছে দেওয়া হবে।
দিদির শপথ ৫) আমাদের অঙ্গিকার, নিরাপত্তা বাড়বে সবার। প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর যুবকদের উন্নতির স্বার্থে অন্যান্য অনগ্রসর শ্রেণি,তপশিলি জাতি ও তপশিলি উপজাতি ভূক্তদের জন্য উচ্চশিক্ষা বৃত্তি বাড়ানো হবে। ভারতের ৬০ বছরের বেশি বয়স্ক ব্যক্তিদের জন্য বার্ধক্য ভাতা বৃদ্ধি করে বার্ষিক ১২ হাজার টাকা করা হবে।
দিদির শপথ ৬) বর্ধিত আয় নিশ্চিত এবার, ফুটবে হাসি অন্নদাতার। স্বামীনাথন কমিশনের সুপারিশ অনুসারে ভারতের কৃষকদের জন্য ন্যূনতম সহায়ক মূল্য প্রদানের আইনগত গ্যারিন্টি দেওয়া হবে। সমস্ত উৎপাদিত ফসলের দাম উৎপাদন খরচের চেয়ে কমপক্ষে ৫০% বেশি ধার্য করা হবে।
দিদির শপথ ৭) স্বল্প মূল্যে পেট্রোপণ্য, ভারতবর্ষে সকলে ধন্য। পেট্রোল,ডিজেল, এলপিজি সিলিন্ডারের দাম সাশ্রয়ী মূল্যে সীমাবদ্ধ করা হবে। দামের ওঠানামা পরিচালনা করার জন্য প্রাইস স্টেবিকাইজেশন ফান্ড তৈরী করা হবে।
দিদির শপথ ৮) নিশ্চিন্ত ভবিষ্যৎ অর্জন, যুবশক্তির গর্জন। ২৫ বছর পর্যন্ত সমস্ত স্নাতক ও ডিপ্লোমা হেল্ডারদের তাঁদের দক্ষতা ও কর্মসংস্থান বাড়াতে এক বছরের শিক্ষানবিশ প্রতিশিক্ষা প্রদান করা হবে। শিক্ষানবিশদের অর্থনৈতিক ভাবে নিজেদের সহায়তা করার জন্য একটি মাসিক বৃত্তি প্রদান করা হবে। উচ্চশিক্ষা গ্রহণকারী শিক্ষার্থীদের ১০ লক্ষ টাকার স্টুডেন্ট ক্রেডিট কার্ড প্রদান করা হবে।
দিদির শপথ ৯) স্বচ্ছ আইন, স্বাধীন ভারত। ধোঁয়াশা যুক্ত সিটিজেনস অ্যামেন্ডমেন্ট অ্যাক্ট বা সিএএ বিলুপ্ত করা হবে। এনআরসি বন্ধ করা হবে। ইউনিফর্ম সিভিল কোড ভারত জুড়ে প্রয়োগ করা হবে না।
দিদির শপথ ১০) এগিয়ে বাংলা, এগোবে ভারত। বাংলার কন্যাশ্রী প্রকল্পের সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে ১৩ থেকে ১৮ বছর বয়সী মেয়েদের শিক্ষার জন্য বার্ষিক ১ হাজার টাকা এবং এককালীন ২৫ হাজার টাকা অনুদান দেওয়া হবে। বাংলার লক্ষ্মীর ভান্ডার প্রকল্পের সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে সমস্ত মহিলাদের মাসিক আর্থিক সহায়তা দেওয়া হবে। আয়ুষ্মান ভারত স্বাথবিমাটির বদলে একটি উন্নততর স্বাস্থ্যসাথী বিমা চালু করা হবে, যা ১০ লক্ষ টাকা বিমার সুবিধা প্রদান করবে।
তৃণমূলের নির্বাচনী ইস্তেহারের মূলে রয়েছে এই ১০টি দিদির শপথ।
অমিত মিত্র এই বিষয়টি ব্যাখ্যা করার পর চন্দ্রিমা ভট্টাচার্য বলেন, তৃণমূল কংগ্রেস ইন্ডিয়া জোটের সঙ্গে কেন্দ্রীয় সরকার গঠন করা মাত্রই এই সব প্রতিশ্রুতি পূরণে প্রতিজ্ঞাবদ্ধ থাকবে। চন্দ্রিমা ভট্টাচার্য ইস্তেহারের দ্বিতীয় পর্যায়টি ব্যাখ্যা করতে গিয়ে বলেন, “দিদির ১০টি শপথকে কেন্দ্র করে ১৫টি অধ্যায় আছে। এগুলোর মধ্যে প্রথমেই রয়েছে নিশ্চিত সুশাসন, বাংলার উন্নয়ন। দু নম্বরে রয়েছে আর্থিক শ্রীবৃদ্ধি, সামাজিক সমৃদ্ধি। তিন নম্বরে রয়েছে, শিল্পায়নের জোয়ার, উন্নয়ন সবার। চার নম্বরে আছে অধিক উৎপাদন, কৃষকের উন্নয়ন সাধন। পাঁচ নম্বরে আছে শিক্ষার অগ্রগতি, সমাজের প্রগতি। ছয় নম্বরে আছে সুস্বাস্থ্যের অঙ্গিকার, সুস্থ বাংলা সবার। সাত নম্বরে আছে পরুকাঠামো উন্নতি, দৈনন্দিন জীবনে অগ্রগতি। আট নম্বরে আছে জাতীয় সুরক্ষায়, আমরাই করব জয়। নয় নম্বরে আছে স্বাবলম্বী নারী, জয়জয়কারকারী। দশ নম্বরে আছে যুব শক্তির বিকাশ, আগামীর আশ্বাস। এগারো নম্বরে আছে সংখ।যলঘু ও তপশিলি, সকলে মিলে এগিয়ে চলি। বারো নম্বরে আছে বাংলাই গড়েছে আজ, সুরক্ষিত নতুন সমাজ। তেরো নম্বরে আছে সংস্কৃতির প্রতিপালন, ঐতিহ্যের সংরক্ষণ।ষণ। চোদ্দো নম্বরে আছে সংস্কৃতি, ঐতিহ্য, পর্যটন, সবার সেরা বাংলা এখন। পনেরো নম্বরে আছে জীববৈচিত্র্য সংরক্ষিত, পরিবেশ সুরক্ষিত।
চন্দ্রিমা ভট্টাচার্য বলেন, ১০০ পাতার আমাদের এই ইস্তেহারে বিবিধ কথা বলা হয়েছে। মনে রাখতে হবে এটা দিদির শপথ। আর দিদি শপথ নিলে তা বাস্তবায়িত হয়, শপথ শুধু কথার কথা থাকে না, সেটা শুধু মাত্র বাংলা নয়, সারা দেশের মানুষ, বাংলার মানুষ দেখেছেন। এই ইস্তেহারে যুবক, শ্রমিক,কৃষক,বৃদ্ধ,বৃদ্ধা, তপশিলি জাতি, তপশিলি উপজাতিদের কথা, মহিলাদের অগ্রগতির কথা, শিক্ষার কথা বলা রয়েছে। বাংলায় মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় মহিলাদের যে অধিকার দিয়েছেন সেটার আরও বিস্তারলাভ হবে।
রাজ্যে ২.১২ কোটি মহিলা লক্ষ্মীর ভান্ডারে অন্তর্ভুক্ত আছেন বলে চন্দ্রিমা ভট্টাচার্য জানান। তিনি বলেন, লক্ষ্মীর ভান্ডারে এখন সাধারণ মহিলারা ১ হাজার টাকা এবং তপশিলি জাতি, উপজাতির মহিলারা পাচ্ছেন ১২০০ টাকা প্রতি মাসে। তৃণমূল যদি ইন্ডিয়া জোটের সরকার কেন্দ্রে গঠন করতে পারে তাহলে লক্ষ্মীর ভান্ডারের রাজ্যের টাকা যেমন রাজ্যের মহিলারা পাবেন তেমন কেন্দ্র থেকেও সমপরিমাণ টাকা পাবেন এটাই দিদির মহিলা স্বশক্তিকরণের প্রতিজ্ঞা। এছাড়া স্বাস্থ্য, স্বনির্ভর গোষ্ঠীকে সারা দেশে আরও শক্তিশালী করা হবে। এছাড়া বিজেপি যে ইস্তেহার প্রকাশ করেছে তাতে মহিলা স্বশক্তিকরণের কোনও দিশা নেই। তারা শুধু স্বনির্ভর গোষ্ঠী করার কথা বলেছে। তাই বলছি সারা দেশে যে স্বনির্ভর গোষ্ঠী আছে তার একতৃতীয়াংশ বাংলার। তাই দিদির শপথে যা বলা আছে সমস্তটাই আমরা কেন্দ্রে সরকার গড়লে করব।
তৃণমূলের এই ইস্তেহারে দিদির ১০টি শপথে শুধু অনুদান এবং ভাতার কথা উল্লেখ করা আছে। একই রকম ভাবে বিজেপিও তাদের ইস্তেহারে এই অনুদান এবং ভাতার কথা ঘেষণা করেছে। একটা দেশ পরিচালনা করতে হলে প্রযুক্তি, বিজ্ঞান, পরিকাঠামো, শিল্প কারখানা, কৃষি উৎপাদন, বেকার সমস্যা নিরসন, কর্মসংস্থানের লক্ষ্যে শিল্প স্থাপনের যে দিকগুলি অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ সেই বিষয়ে তৃণমূল যেমন তাদের ইস্তেহারে কিছু বলেনি নিজেপি ও একই ভাবে এই বিষয়গুলির দিকে আলোকপাত করেনি। এখন প্রশ্ন একটাই নরেন্দ্র মোদীর এনডিএ বা মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের ইন্ডিয়া যে জোটই ভারতে সরকার গড়বে তাদের কিন্তু স্থায়ী উন্নয়নের কথা ভাবতে হবে। শুধুমাত্র ভোট পাওয়ার জন্য জনমুখি রাজনীতি করে মানুষের মন পেতে চেষ্টা করলে তাতে দেশের স্থায়ী উন্নয়ন হবে না।