মহানগর ডেস্ক: মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় ও তৃণমূল চাইছিল বাংলায় প্রদেশ কংগ্রেস সভাপতি অধীর রঞ্জন চৌধুরীকে একঘরে করতে। তৃণমূল সাংসদ কল্যাণ বন্দ্যোপাধ্যায় রেড রোডের ধর্ণা মঞ্চ থেকে সরাসরি জানিয়েই দিয়েছিলেন, “সোনিয়াজি, রাহুল গান্ধীর সঙ্গে আমার যখন একা কথা হয়েছে তখন আমি বলেছি, অধীর রঞ্জন চৌধুরী বাংলায় কংগ্রেসকে উঠিয়ে দেবেন।”
তবে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের দলের অধীরকে বাংলার কংগ্রেস থেকে তাড়িয়ে ছাড়ার মনোবাসনা পূর্ণ হল না। কংগ্রেস হাইকমান্ড বাংলায় ২০২৪-এর লোকসভা নির্বাচনের জন্য যে কমিটি গড়ে দিল তার নেতৃত্বে সেই অধীর রঞ্জন চৌধুরীকেই রাখা হয়েছে। কাজেই খুব স্বাভাবিক ভাবেই বলা যায় তৃণমূলের মাব্যথা বাড়ছে। এতদিন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় সারা বছর কংগ্রেসকে ভাঙার কাজ করেন ঠিক নির্বাচনের আগে সনিয়া গান্ধিকে ম্যানেজ করে বাংলায় কংগ্রেসের সঙ্গে জোট করে নিতেন লোকসভা বা বিধানসভা নির্বাচনের প্রাক মুহূর্তে। সনিয়া গান্ধির মমতার উপর অপার ভালোবাসায় এই কাজটি সমাধা হচ্ছিল। বাংলার কংগ্রেসের গুটিকয় যে নেতানেত্রী আছেন তাঁরা চিৎকার করে মরলেও তাতে সোনিয়া কর্ণপাত না করে উল্টে বাংলা কংগ্রেস নেতৃত্বকে মমতার পিছনে চলার নির্দেশই দিতেন। ২০১৬-র পর থেকে পরিস্থিতি বদলেছে। ২০১৯ এর লোকসভা, ২০২১ এর বিধানসভায় মমতার বাংলা কংগ্রেসের অভিভাবক হওয়ার ইচ্ছে মর্যাদা পায়নি। এবার তো দিল্লিতে কাকভোরে ডৃণমূলের সেনাপতি অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায় গিয়ে রাহুল গান্ধীর দরজায় কড়া নাড়ার পর কথা হলেও বাংলায় কংগ্রেস ভাঙতে আর সফল হয়নি মমতার চাল। ফলে সেই থেকেই রাগ বাড়ছিল বাংলায় ভোটের আগে কংগ্রেসের গুরুমা হয়ে ওঠা মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের। শেষ পর্যন্ত তিনি ঘোষণাই করে বলসেন, “বাংলায় কংগ্রেসের সঙ্গে তৃণমূলের সম্পর্ক নেই। তৃণমূল সেকুলার দল, বাংলায় একাই লড়বে। অল আউট খেলবে তৃণমূল।”
আসলে মমতাকে একা খেলতে, অল আউট খেলতে কেউ নিষেধ করেননি। মমতা নিজেই ঠিক করে দেওয়ার দায়িত্ব নিয়ে ফেলেছিলেন, এই রাজ্যে কংগ্রেসকে দুটো আসনে তিনি লড়তে দেবেন। তার থেকে সিপিএমকে কংগ্রেস একটা আসন দিলে তাঁর আপত্তি নেই। বাংলায় মানুষের পালস মমতা ভালো বোঝেন। ওটাই তাঁর পলিটিক্যাল ইউএসপি। তাতে তিনি বুঝেদিলেন, সংখ্যালঘুরা অনুদান পাওয়া ছাড়া তাঁর সরকারের কাছ থেকে স্থায়ী উন্নয়ন, চাকরি বিশেষ পায়নি। তাই কংগ্রেসকে বগলবাদা করা গেলে বাংলার যে ২৮ শতাংশের কাছাকাছি সংখ্যালঘু ভোট আছে তা নিয়েই তিনি ভোটযুদ্ধে রত হতে পারবেন। কিন্তু কংগ্রেসকে ম্যানেজ করতে না পারায় তাঁর এখন আর ১০০ তে ২৮ পেয়ে ভোটে লড়া সম্ভব হচ্ছে না। তাই খুব স্বাভাবিক ভাবেই তিনি বাংলা কংগ্রেসের মূল কান্ডারি অধীর রঞ্জন চৌধুরীর বাপবাপান্ত শুরু করেছেন। বলছেন অধীর এক নম্বর বিজেপির দালাল। লক্ষ্য একটাই এসব বলে যদি কংগ্রেসের ভাড়ার থেকে সংখ্যালঘু ভোটের কিছুটা নিজের দিকে ট্রান্সফার করানো যায়। মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের এই সংখ্যালঘু প্রীতি ভোটের আগে মাথাচাড়া দেয়,এবারও সেটাই হচ্ছে।
তবে মল্লিকার্জুন খাড়গে এআইসিসি-র সভাপতি হলেও দল চলছে রাহুল গান্ধির নির্দেশে। তাই রাহুল গান্ধি প্রতিবারের মতো এবার আর মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়কে “বারে বারে ঘুঘু তুমি খেয়ে যাও আমার ধান”, এই কায়দায় কংগ্রপসকে ভাঙতে দেননি। মমতার কংগ্রেসের ধান খাওয়া তাই সম্ভব হলোনা। এতেই মমতা যারপরনাই চটেছেন। রাহুল গান্ধী মমতার এই অসন্তোষ খুব ভালো ভাবে তাড়িয়ে তাড়িয়ে উপভোগ যে করছেন তা তাঁর কাজেই প্রমাণ, কেননা তিনি তাঁর ভারত জোড়ো ন্যায় যাত্রায় নিজের পাশে সিপিএমকে ডাকলে বাংলায় আসছেন বলে মমতাকে একটা ফোন পর্যন্ত করেননি। আর যে অধীরকে তাড়িয়ে দেওয়ার জন্য কল্যাণ বন্দ্যোপাধ্যায়ের কথা অনুসারে রাহুল গান্ধী, সনিয়া গান্ধির কাছে তিনি নিজে সুপারিশ করেছিলেন, সেই অধীর কিন্তু পুরো বাংলায় ন্যায় যাত্রায় রাহুলের পাশেই দন্ডায়মান ছিলেন। এসব দেখে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় ও তাঁর সঙ্গীসাথীদের চটে যাওয়াটা খুব স্বাভাবিক। তাই অধীরের নামে যা ইচ্ছে বলা শুরু করেছে তৃণমূল।
এবার সম্ভবত আরো চটবেন তৃণমূলনেত্রী ও তাঁর দলের নেতারা। কেননা প্রদেশ কংগ্রেস সভাপতি অধীর চৌধুরীর নেতৃত্বাধীন ওই কমিটিতে রয়েছেন, প্রদীপ ভট্টাচার্য, দীপা দাশমুন্সী, সাংসদ আবু হাসেম খান চৌধুরী, দেবপ্রসাদ রায়, আব্দুল মান্নান, মনোজ চক্রবর্তী, নেপাল মাহাতো, শঙ্কর মালাকার, মোহিত সেনগুপ্ত, মনোরঞ্জন হালদার, মায়া ঘোষ, সৌম্য আইচ রায়, মহম্মদ মুখতার, অসিত মিত্র, নীলয় প্রামাণিক, সুজয় ঘটক, মোস্তাক আলম, দিব্যেন্দু মিত্র, শুভঙ্কর সরকার, দীপ্তিমান ঘোষ, আশুতোষ চট্টোপাধ্যায়, সানিয়া জাভেদ এবং কৃষ্ণা দেবনাথ। এ ছাড়াও পদাধিকার বলে ছাত্র পরিষদ, যুব কংগ্রেস, মহিলা কংগ্রেস এবং কংগ্রেস সেবাদলের রাজ্য সভাপতিরা কমিটিতে জায়গা পেয়েছেন বলে কংগ্রেসের প্রেস বিজ্ঞপ্তিতে জানিয়েছেন এআইসিসির সাধারণ সম্পাদক কেসি বেণুগোপাল। প্রসঙ্গত, লোকসভা ভোটে তৃণমূলের সঙ্গে আসন সমঝোতার সম্ভাবনা কমে আসায় বামেদের সঙ্গে জোট বাঁধাকেই ‘বিকল্প’ হিসাবে প্রদেশ কংগ্রেসে নেতৃত্ব প্রাধান্য দিচ্ছে আগের মতো। সুজন চক্রবর্তী ইতিমধ্যেই জানিয়ে দিয়েছেন, “এবার দ্রুত কংগ্রেসের সঙ্গে আসন সমঝোতা নিয়ে আলোচনা হয়ে যাবে।”
এই পরিস্থিতিতে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের রাগ হওয়াটা স্বাভাবিক। কংগ্রেস যে অধীরকে গুরুত্ব দিয়ে বাংলায় সিপিএমের সঙ্গে যাবে সেটা মমতা বিলক্ষণ জানতেন। তাই তিনি আগে থেকে বিষয়টা নিজের মতো করে সাজাতে ময়দানে নামলেও রাহুল গান্ধিকে তিনি ম্যানেজ করতে পারেননি। তাই যা না তাই বলে রাহুল গান্ধি ও কংগ্রেসকে গাল দেওয়ার কাজে কুণাল ঘোষ থেকে কল্যাণ বন্দ্যোপাধ্যায় সবাইকে ভোটের বাজারে ছেড়েছেন মমতা। তবে ২০১৯ এর লোকসভা নির্বাচনের আগে তৃণমূলের ২ মন্ত্রী সহ একগুচ্ছ বিভিন্ন মাপের নেতা দুর্নীতির দায়ে জেলে ছিলেন না। এবার কিন্তু সেই পরিস্থিতিতে আছে মমতার দল। তাই তিনি চেয়েছিলেন বাংলায় কংগ্রেসকে ২টো আসন ছেড়ে তৃণমূল ৪০টি আসনে লড়বে এবং অবধারিতভাবে ভোটের ফলে মমতার নিজের দল প্রথম হবে, আর তাঁর ইচ্ছেয় বিজেপি দ্বিতীয় হবে। বাকি কংগ্রেস-বামকে সাইনবোর্ডে পরিণত করার তাঁর দীঘ মনোবাসনা পূর্ণ হবে। সেটা না হওয়ায় এখন চাপে পড়েছেন মমতা। তাই ১৯৭৭ থেকে ২০১১ পর্যন্ত বামেরা কত দুর্নীতি করেছে, কত কংগ্রেস কর্মী মেরেছে এই হিসাব দিয়ে বলছেন, এর পরেও কংগ্রেস কেন যাচ্ছে সিপিএমের সঙ্গে? মমতার চিন্তাটা নীতির নয়, ক্ষমতায় টিকে থাকার, তাই তার জন্য তিনি কংগ্রেসের সঙ্গে ভোটের আগে পুরনো ছকে খেলতে গিয়ে রাহুল গান্ধির কাছে নজরবন্দী হয়ে গিয়েছেন। এবার যত ভোট এগিয়ে আসবে ততোই বাড়বে মমতার কংগ্রেসের বিরুদ্ধে অকথা, কুকথা বলা।