মহানগর ডেস্ক: নির্বাচনী বন্ড নিয়ে রায় দিল দেশের শীর্ষ আদালত। বৃহস্পতিবার সুপ্রিম কোর্টের প্রধান বিচারপতি ডিওয়াই চন্দ্রচূড়ের নেতৃত্বাধীন পাঁচ বিচারপতির সাংবিধানিক বেঞ্চ জানিয়ে দিল, নির্বাচনী বন্ড প্রকল্প “অসাংবিধানিক”। তাই এই বন্ড “বাতিল হওয়া উচিত”।
বৃহস্পতিবারের শুনানিতে শীর্ষ আদালতের তরফে জানানো হয়, নির্বাচনী বন্ডের তথ্য জানার অধিকার বা আরটিআই -কে আইনকে লঙ্ঘন করছে। এর ফলে কেন্দ্রের নরেন্দ্র মোদী সরকারের অস্বস্তি যে অনেকটাই বাড়ল তা আর বলার অপেক্ষা রাখে না।
নির্বাচনী বন্ড প্রকল্পে বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের টাকা পাওয়ার বিষয়টির বৈধতাকে চ্যালেঞ্জ করে দায়ের হওয়া একগুচ্ছ মামলার শুনানিতে গত নভেম্বরেই সুপ্রিম কোর্টের পর্যবেক্ষণে বলা হয়েছিল, নির্বাচনী বন্ডের মাধ্যমে কারা শাসক দলকে আর্থিক সাহায্য দিচ্ছে, সেই তথ্য গোপন রাখা গেলেও একই প্রকল্পে বিরোধীদের পাওয়া টাকার সূত্র প্রকাশ পেয়ে যেতে পারে। সেই সঙ্গে “রাজনৈতিক দলগুলোর আর্থিক অনুদানের উৎস সম্পর্কে ভোটারের কিছুই জানার অধিকার থাকতে পারে না”— মোদী সরকারের ওই যুক্তিও খারিজ করে দিয়েছিল শীর্ষ আদালত।
প্রসঙ্গত, নরেন্দ্র মোদী সরকার ভোটে কালো টাকার দেদার লেনদেন বন্ধ করার লক্ষ্যেই নির্বাচনী বন্ড চালু করে। কেন্দ্রীয় অর্থমন্ত্রী থাকাকালীন ২০১৮ সালে প্রয়াত অরুণ জেটলি নির্বাচনী বন্ডের কথা ঘোষণা করেছিলেন। ২০১৭-র অর্থ বিলের মাধ্যমে আইনে একগুচ্ছ সংশোধনী এনে কেন্দ্রের নরেন্দ্র মোদী সরকার ২০১৮ থেকে নির্বাচনী বন্ড চালু করে দেয়। এর ফলে কোনও ব্যক্তি বা কর্পোরেট সংস্থা রাজনৈতিক দলগুলিকে চাঁদা দিতে চাইলে, বন্ড কিনে সংশ্লিষ্ট দলকে টাকা বা চাঁদা দিতে পারে। ১ হাজার, ১০ হাজার, ১ লক্ষ, ১০ লক্ষ এবং ১ কোটি টাকা মূল্যের বন্ড পাওয়া চালু হয়ে যায়। রাজনৈতিক দলগুলিও নির্দিষ্ট অ্যাকাউন্টে সেই বন্ডের থেকে পাওয়া টাকা ভাঙিয়ে নিতে পারে। কিন্তু কে, কত টাকা দিচ্ছেন তা এই পদ্ধতিতে বোঝার কোনও উপায় ছিল না।
এর ফলে নির্বাচনী বন্ড চালু হওয়ার পর থেকেই বিষয়টির স্বচ্ছতা নিয়ে নানান মহলে প্রশ্ন উঠেছিল। বিভিন্ন মহল থেকে যারা এই প্রক্রিয়ার বিরোধীতা করেছিল, তাদের অভিযোগ ছিল, এভাবে নির্বাচনী বন্ডের মাধ্যমে কোন দল কত টাকা পাচ্ছে তার উৎস জানতে না পারলে অস্বচ্ছতা অবশ্যই বাড়বে। অভিযোগকারীরা আরও বলে, বিশ্বের কোনও দেশেই এই ব্যবস্থা কার্যকর নেই, রাজনৈতিক দল সেখানে বন্ড ভাঙাতে পারে না। ফলে কোন কর্পোরেট সংস্থা কাকে ভোটে সাহায্য করছে, তার বিনিময়ে ক্ষমতাসীন দলের থেকে সেই সংস্থা কী এবং কতটা সুবিধা পাচ্ছে সেটা জানার কোনওই উপায় থাকছে না।
বন্ড-বিরোধীদের দাবি ছিল, কেন্দ্র এবং অধিকাংশ রাজ্যে ক্ষমতায় থাকার সুবাদে নির্বিবাদে অর্থ আমদানির কার্যত পাকাপাকি বন্দোবস্ত করে ফেলতে চাইছে বিজেপি। এই ভাবে প্রচুর টাকার আমদানি বজায় রাখতেই বিজেপি নির্বাচনী বন্ড চালু রাখতে আপ্রাণ চেষ্টা চালাচ্ছে। প্রায় ৫ বছর ধরে সুপ্রিম কোর্টে ঝুলে থাকা মামলা চলাকালীন ৫ জন প্রধান বিচারপতি এসেছেন। প্রতি বারেই মোদী সরকারের বন্ড-প্রীতি স্পষ্ট হয়েছে শীর্ষ আদালতে। এবার কিন্তু সুপ্রিম কোর্ট তার রায়ে জানিয়ে দিল, “নির্বাচনী বন্ড অসাংবিধানিক, বাতিল হওয়া উচিত।”
সম্প্রতি অ্যাসোসিয়েশন ফর ডেমোক্রেটিক রিফর্মস বা এডিআর দেশের জাতীয় দলগুলির ঘোষিত তথ্য থেকে বিভিন্ন কর্পোরেট সংস্থার কাছ থেকে কোন দল কত অনুদান পেয়েছে তার হিসাব প্রকাশ করেছে। সেই হিসাবে দেখা যাচ্ছে ২০২১-২২-এর তুলনায় ২০২২-২৩ অর্থবর্ষে কর্পোরেট সংস্থা এবং ব্যবসায়ীদের থেকে বিজেপির অনুদান ১৭ শতাংশেরও বেশি বেড়েছে। গত অর্থবর্ষে মোদী-শাহের দলের পাওয়া অনুদানের অঙ্ক ছিল ৬১৪ কোটির সামান্য বেশি।
স্বীকৃত জাতীয় দলগুলি ২০২২-২৩ অর্থবর্ষে মোট ১২,১৬৭ জন দাতা-র বা অনুদান প্রদানকারী সংস্থার কথা জানিয়েছে। এর মধ্যে বিজেপি অনুদান পেয়েছে ৭,৯৪৫ সংস্থা এবং ব্যক্তির কাছ থেকে। ২০২২-২৩ অর্থবর্ষে কংগ্রেস ব্যবসায়ী এবং কর্পোরেট সংস্থাগুলির থেকে পেয়েছে ৭৯ কোটি ৯২ লক্ষ টাকা। যা ২০২১-২২-এর ১৬ শতাংশ কম। তৃতীয় স্থানে থাকা সিপিএম ৩ কোটি ৯৭ লক্ষ এবং চতুর্থ স্থানে থাকা আম আদমি পার্টি ১ কোটি ১৪ লক্ষ টাকা অনুদান পেয়েছে গত অর্থবর্ষে।
দেশের জাতীয় দলগুলি ২০২২-২৩ অর্থবর্ষে ৮৫০ কোটি টাকারও বেশি অনুদান হিসাবে পেয়েছে বিভিন্ন ব্যবসায়ী এবং কর্পোরেট সংস্থার কাছ থেকে। এই অনুদান প্রাপ্তির তালিকার শীর্ষে রয়েছে বিজেপি। তারা একাই পেয়েছে ৭১৯ কোটি ৮০ লক্ষ টাকা। দ্বিতীয় স্থানে কংগ্রেস থাকলেও নরেন্দ্র মোদী-অমিত শাহের দল বিজেপির সঙ্গে কংগ্রেসের অনুদান প্রাপ্তির অনেকটাই পার্থক্য।