Home Bengal গার্ডেনরিচকাণ্ডের দায় কার? কি বলছেন স্থানীয়রা? কী বলছেন বিরোধীরা? শাসকদলই বা কী বলছে?

গার্ডেনরিচকাণ্ডের দায় কার? কি বলছেন স্থানীয়রা? কী বলছেন বিরোধীরা? শাসকদলই বা কী বলছে?

by Sibapriya Dasgupta
35 views

মহানগর ডেস্ক : ১৪ বছর কলকাতা পুরসভা তৃণমূল কংগ্রেসের হাতে। এখনও গার্ডেনরিন এলাকার নির্মীয়মাণ বহুতল ভেঙে পড়ার পর কলকাতার মেয়র এবং রাজ্যের পুর ও নগর উন্নয় মন্ত্রী ফিরহাদ হাকিম বামফ্রন্টের উপরই দায় চাপালেন।

ফিরহাদ হাকিম এই বহুতল ভেঙে পড়ার ঘটনায় বলেছেন, “এসব রীতি বামফ্রন্ট আমল থেকে চলে আসছে। আগে বিএলআরও অফিসে যেতে জুতো ছিঁড়ে যেত। এখন অ্যাডেড এরিয়ার বিএলআরও কেএমসি অফিসে নিয়ে এসেছি।” পাশাপাশি ফিরহাদ হাকিম স্বীকারও করেছেন, “যে বহুতলটি ভেঙে পড়েছে সেটা বেআইনি। সম্প্রতি সেটার নির্মাণ শুরু হয়েছিল।”

তবে মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় ঘটনাস্থলে দাঁড়িয়ে সোমবার সকালে বলেছেন, “মেয়রের কাছে জানতে চাইলাম, বাড়িটার আইনি অনুমোদন ছিল কি না, মেয়র বলেছেন না, মানে বহুতলটি বেআইনি। দোষীদের শাস্তি হবে।”

মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় যখন বলছেন গার্ডেনরিচের ভেঙে পড়া বহুতলটি বেআইনি, দোষীদের শাস্তি হবে। তখনই কলকাতার মেয়র এবং যেখানে বাড়ি চাপা পড়ে ৯ জন মানুষের প্রাণহানির ঘটনা ঘটেছে, সেখানকার বিধায়ক এবং রাজ্যের পুর ও নগর উন্নয় মন্ত্রী এবং কলকাতার মেয়র ফিরহাদ হাকিম বলছেন, “কাউন্সিলর এসব জানবেন কি করে? এসব প্রশাসন জানে। আর এতো বাড়ির কোন গলিতে, কেথায় একটা বেআইনি নির্মাণ হচ্ছে তা জানা সম্ভব নয়। এসব প্রশাসন জানে।” তাহলে প্রশ্ন উঠছে এই ঘটনার দায় কি স্থানীয় ১৩৪ নম্বর ওয়ার্ডের তৃণমূল কাউন্সিলর সামস ইকবালের উপর বর্তায় না? তিনি কি দোষী নয়? মুখ্যমন্ত্রীর কথায় দোষীর তালিকা থেকে কি সামস ইকবালকে আড়াল করছেন ফিরহাদ হাকিম?

স্থানীয় ১৩৪ নম্বর ওয়ার্ডের তৃণমূল কাউন্সিলর সামস ইকবালকে দরাজ সার্টিফিকেট দিয়ে ফিরহাদ হাকিম যখন বলেছিলেন এসব প্রশাসন জানে, তখনই ইঙ্গিত পাওয়া যাচ্ছিল পুরসভার ইঞ্জিনিয়ারদের উপর এই বেআইনি নির্মাণের দায় চাপতে চলেছে। বাস্তবে হলও তাই। কলকাতা পুরসভার ৩ ইঞ্জিনিয়ারকে শো-কজ করা হল।

গার্ডেনরিচের যে এলাকায় নির্মীয়মাণ ৬ তলা বহুতলটি ভেঙে ৯ জনের জীবন স্তব্ধ হয়ে গেছে সেখানকার আরও ৬টি বাড়ি হেলে আছে। স্থানীয় বাসিন্দারা অভিযোগ করছেন, যে ৬ তলা বাড়িটি এখানে তৈরী হয়েছিল সেটা বেআইনি। ২২ কাঠার একটা পুকুর বুজিয়ে এই বহুতলটি তৈরী হয়েছে। একানকার বেশিরভাগ বাড়ি বেআইনি। অনেক বাড়ির দোতলার প্ল্যান অনুমোদন করা হয়, তারপর তার উপর তিন,আার,পাঁচ,ছয় তলা উঠে যায়। এই এলাকায় বহু পুকুর বুজিয়ে বাড়ি তৈরী হচ্ছে। যে বাড়িটি ভেঙে পড়েছে সেই জায়গায় আগে একটা বড় পুকুর ছিল। সেই পুকুরটি বুজিয়ে রাতারাতি এই বাড়িটি তৈরী হল। কাউন্সিলর কিছু জানেন মা? এই নিয়ে কাকে অভিযোগ করব? শুনবে কে? বেশি কিছু বললে প্রাণটাই চলে যাবে।

তবে একদিকে বামফ্রন্ট অন্যদিকে প্রশাসনের উপর দোষ চাপিয়ে যে লোকসভা নির্বাচনের আগে রেহাই পেতে চাইছে রাজ্যের শাসক দল, সেটা বোঝা যাচ্ছে। আর ভোটের মুখে নিজেদের মুখ বাঁচাতে তাই কলকাতা পুরসভার সবকটি বরোতে বেআইনি বাড়ি খুঁজে বার করা এবং বেআইনি অংশ ভেঙে ফেলার উদ্যোগ নিয়েছে কলকাতা পুরসভা। বেআইনি অংশ ভেঙে ফেলতে প্রোমোটারকে প্রথমে বলা হবে, তারা সেই কাজ না করলে কলকাতা পুরসভাই ভাঙার কাজ করবে। এটা প্রশাসনের কাজ, সঠিক কাজ বললে অত্যুক্তি হবে না। কিন্তু পুর প্রশাসন এই কাজটা এতোদিন কেন করেনি? সেই প্রশ্ন কি কলকাতা পুরসভা যে দল গত ১৪ বছর ধরে পরিচালনা করছে তারা এড়িয়ে যেতে পারে? আর ভাঙা অংশের যারা বাসিন্দা তাদের বর্তমান বাজার মূল্যে সম মাপের বাড়ি কি প্রশাসন দেবে? কেন না এই সব বাড়ি রেজিষ্ট্রেশনের টাকা কিন্তু সরকার নিয়েছে। এদের মধ্যে অনেকে বাড়ির কর দেয়,যা কলকাতা পুরসভা পায়। তাহলে ভেঙে ফেলা অংশের বাসিন্দাদের কি হবে?

এদিকে গার্ডেনরিচের বহুতলটি ভেঙে পড়ার সঙ্গে সঙ্গে বিরোধীদের সমালোচনা শুরু হয়েছে শাসক দলের বিরুদ্ধে। এই সমালোচনা কোনও অপ্রত্যাশিত ঘটনা নয়। বিরোধীরা ঘটনাস্থলে পৌঁছে বিপর্যস্ত মানুষগুলোর পাশে দাঁড়াতে চেষ্টা করছেন। ঘটনার দায় নির্দিষ্ট ভাবে এবং যুক্তি দিয়ে চাপাচ্ছেন শাসক দলের উপর।

বিজেপি, সিপিএম, কংগ্রেস, আইএসএফ- সবকটি দলের নেতানেত্রীরা গার্ডেনরিচে গিয়েছেন এবং সবাই একযোগে অভিযোগ করেছেন, সম্পূর্ণ দুর্ঘটনাটি ঘটেছে কলকাতা পুরসভা, স্থানীয় কাউন্সিলর, স্থানীয় বিধায়ক, পুলিশ এবং প্রশাসনের যোগসাজশে। যে রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী বলেন বলেন, রাজ্যের মানুষের দুয়ারে সরকার অর্থাৎ প্রশাসন পৌঁছে গেছে, রাজ্যে চালু হয়েছে দুয়ারে সরকার প্রকল্প, সেই রাজ্যের মধ্যে কলকাতা পুরসভার ১৩৪ নম্বর ওয়ার্ডে পুকুর বুজিয়ে বেআইনি ৬ তলা বাড়ি ৪ ফুট রাস্তার উপর তৈরী হল, ভেঙে পড়ল অথচ সেই ঘটনা স্থানীয় কাউন্সিলর জানেন না? এই দাবি অন্য কেউ নয় করছেন খোদ কলকাতার মেয়র ফিরহাদ হাকিম। তাহলে কি গার্ডেনরিচে দুয়ারে সরকার হয়নি? সেখানকার দুয়ারে সরকার প্রকল্পে ১৩৪ নম্বর ওয়ার্ডের কাউন্সিলর সামস ইকবালের কি অংশগ্রহণ ছিল না? এই প্রশ্ন উঠছে বিরোধী শিবির থেকে। বিরোধী শিবির থেকে প্রশ্ন উঠছে সামস ইকবালের সঙ্গে এই ভেঙে পড়া বাড়ির প্রোমোটার মহম্মদ ওয়াসিমের বিভিন্ন অনুষ্ঠানে উপস্থিত থাকার একাধিক ছবি নিয়ে। অথচ সামস ইকবাল বলছেন, তিনি তাঁর ওয়ার্ডে পুকুর বুজিয়ে এই বহুতল তৈরী এবং ভেঙে পড়ার আগের মুহূর্ত পর্যন্ত কোনও কিছুই জানতেন না?

এদিকে রাজ্যের বিরোধী দলনেতা শুভেন্দু অধিকারী এই বহুতল বিপর্যয়ের পর বলেছেন, “ফিরহাদ হাকিমের নির্দেশ ছাড়া দক্ষিণ কলকাতার একটা গাছের পাতাও নড়ে না। আর উনি বলছেন কাউন্সিলার কিছু জানে না, এতো বাড়ির মধ্যে কোন গলিতে বেআইনি বাড়ি তৈরী হচ্ছে তা তিনি জানেন না? ওই কাউন্সিলরকে গ্রেফতার করতে হবে।”

আমরা অতীতে দেখেছিলাম একটি অনুষ্ঠানকে কেন্দ্র করে রবীন্দ্র সরোবরের মতো জাতীয় সরোবরকে কি ভাবে কিছু মানুষ দূষণে নিমজ্জিত করেছিল। তখন ধর্মীয় আবেগে আঘাত না করার জন্য ন্যাশনাল গ্রিন ট্রাইবুনালের নির্দেশ অমান্য করেছিল কলকাতা পুরসভা, কেএমডিএ। তারপর থেকে ন্যাশনাল গ্রিন ট্রাইবুনাল কড়া হওয়ায় এখন পুজোর নামে রবীন্দ্র সরোবরকে দূষিত করার প্রয়াস বন্ধ হয়েছে, দূষণের হাত থেকে রেহাই পেয়েছে রবীন্দ্র সরোবর।

শাসক এবং দল আলাদা হতে পারে কিন্তু ভালো কাজ হলে দলের জন্য, মন্ত্রী কাউন্সিলরের কৃতিত্ব আর খারাপ কিছু হলে তার দায় বামফ্রন্টের, প্রশাসনের এই যুক্তি মানুষ ধরে ফেলেছে। এভাবে সরকার, সরকারী দলের মন্ত্রী,বিধায়ক, কাউন্সিলর,পঞ্চায়েত সদস্যরা কতদিন দায় এড়িয়ে যাবেন? সব ভালোমন্দের দায় যদি প্রশাসনের হয়, তাহলে ভোটের সময় ভালো কাজের কৃতিত্ব নিতে শাসকদলের প্রার্থীরা ভোট চান কি ভাবে? জনগণ নেতা নির্বাচন করে, এই নেতারাই মন্ত্রী, কাউন্সিলর, পঞ্চায়েত সদস্য, প্রধান হয়ে প্রশাসনের অঙ্গ হয়ে ওঠে, তাই গার্ডেনরিচের বহুতল বিপর্যয়ের দায় শাসকদলকে তো নিতে হবে। আর একদা শাসক দলের প্রাক্তন মেয়র চোভন চট্টোপাধ্যায় নিজেই গার্ডেনরিচের ঘটনার পড় বলেছেন, “৩ জন পুরসভার ইঞ্জিনিয়ারকে শো-কজ করে কি হবে? তাঁরা কি ঘটনা স্থলে গিয়ে কাজ করেন?” প্রাক্তন মেয়রের এই বক্তব্যেরও কি বিরোধীতা করবেন বর্তমান মেয়র? দায় কি সত্যিই এভাবে ঝেড়ে ফেলা যায়? এই প্রশ্ন করছেন গার্ডেনরিচের মানুষ।

You may also like

Mahanagar bengali news

Copyright (C) Mahanagar24X7 2024 All Rights Reserved