Home Lifestyle রাজ্যজুড়ে ভক্তরা অপেক্ষায় স্নানযাত্রার! জানুন এই উৎসবের মাহাত্ম

রাজ্যজুড়ে ভক্তরা অপেক্ষায় স্নানযাত্রার! জানুন এই উৎসবের মাহাত্ম

দেবদেবীর মধ্যে শীতলা মায়ের জনপ্রিয়তা সমধিক।

by Mahanagar Desk
378 views

শালিখা বা সালকিয়ার লৌকিক দেবদেবীর মধ্যে শীতলা মায়ের জনপ্রিয়তা সমধিক। পল্লী বাংলার পালপার্বণের মধ্যে শীতলার নাম সামান্য উল্লেখ থাকলেও সালকিয়ার এই পুজোর কোন উল্লেখ কোন গ্রন্থে চোখে পড়েনি।এর কারণ অজানা।প্রকৃতপক্ষে শীতলা মায়ের স্নানযাত্রা উৎসব এখানকার এক অনন্য উৎসব।মাঘী পূর্ণিমা তিথিতে বসন্ত রোগের দেবী শীতলা মায়ের স্নানযাত্রা সমগ্র উত্তর হাওড়ার এক বিশেষ আঞ্চলিক উৎসব। এই উৎসবে যেমন জাতির গণ্ডি নেই তেমনি ধর্মেরও কোন বাধা নিষেধ নেই।

হিন্দু, বৌদ্ধ, চীনা এমন কি মুসলমানেরাও এই দেবীর কৃপালাভের জন্য মিলিত হয়। মাঘী পূর্ণিমার দিনে উত্তর হাওড়ার সমস্ত রাস্তাঘাটে বেলা থেকে রাত ১২টা অবধি যানবাহন চলাচল বন্ধই হয়ে যায়, শুধুমাত্র জরুরি পরিষেবা ব্যতীত। বিভিন্ন শীতলা মন্দির থেকে মা বের হন গঙ্গায় স্নান করার জন্য। শীতলা অনার্য দেবী হ’লেও এই দেবীর পুজো অতি প্রাচীন। প্রাচীন রামায়ণ ও মহাভারতেও এই পুজোর উল্লেখ দেখতে পাওয়া যায়। বিরাট রাজার রাজ্যে একবার বসন্ত দেখা দিলে বিরাট রাজা পর্যন্ত শীতলা পুজো ক’রে রেহাই পান। বাংলাদেশের অন্যান্য জায়গায় চৈত্র মাসের রাম নবমীতে শীতলার স্নান হ’লেও একমাত্র এখানেই মাঘী পূর্ণিমায় স্নানযাত্রা অনুষ্ঠিত হয়। কবে, কে এই অঞ্চলে এই পুজোর প্রচলন করেছিল তার কোন সঠিক তথ্য পাওয়া যায় না। তবে শোনা যায়, বহুপূর্বে একজন কর্তব্যরত পুলিশ বাঁধাঘাটে মাঘ মাসে পুর্ণিমার গভীর রাতে সাতজন মহিলাকে গঙ্গায় স্নান ক’রতে দেখে। এই দৃশ্যের কথা সে অন্য সকলকে বলায় সে মারা যায়। তারপর থেকেই নাকি এই অঞ্চলে শীতলা মায়ের স্নানযাত্রার প্রচলন। শীতলা গুটিদানা জনিত (হাম, বসন্ত ইত্যাদি) রোগের দেবী। বসন্ত ঋতুতে পৃথিবীপৃষ্ঠ উত্তপ্ত হ’য়ে ওঠে। ভক্তদের বিশ্বাস এই সময়ে দেবী নিজে গঙ্গায় স্নান ক’রে যেমন নিজ দেহ শীতল করেন তেমনি এ দেশের মাটিকেও শীতল করেন।

 

শীতলাদেবী আবার পরিচ্ছন্নতার দেবী। তাই দেখতে পাওয়া যায় যে, অপরিচ্ছন্ন বাড়িতেও ঐ রোগ হালে প্রচলিত ধারণার বশবর্তী হ’য়েই তাঁরা বাড়িঘর পরিচ্ছন্ন করে রাখে। শীতলার রূপ বর্ণনাতেও বলা হয়েছে: নমামি শীতলাং দেবীং রাসভস্থাং দিগম্বরীং। মার্জনীকলসোপেতাং সূর্পালস্কৃতমস্তকাম্। গর্দভ পৃষ্ঠে উলঙ্গ শীতলাদেবী হাতে ঝ্যাঁটা ও কলসী এবং মস্তকে কুলো নিয়ে অধিষ্ঠিতা। এখানে উল্লেখ করা যেতে পারে যে, এখানকার সবকটি শীতলা দেবীই আবক্ষা-কিন্তু অন্যত্র পূর্ণাবয়ব শীতলাদেবীই দেখতে পাওয়া যায়। শীতলাদেবীর মঞ্চে পঞ্চানন ঠাকুর ও জুরাসুর দেবতারও পুজো হয়। ‘শীতলা মঙ্গল’ কাব্যের মতে জুরাসুর হচ্ছে জ্বরের দেবতা। হাম ও বসন্ত ইত্যাদি হবার আগে যে জ্বর হয় এই জুরাসুর তারই দেবতা। জুরাসুরের রূপ হচ্ছে-তিন মাথা, ছয় চোখ, ছয় হাত কিন্তু তিন পা। এই তিন পায়ের ব্যাখ্যা অবশ্য পাওয়া যায়নি। এখানকার যে শীতলাদেবীরা (সাতবোন) আছেন তাঁরা কেউ দারুনির্মিত, বর্তমানে এই শীতলা দেবীর সংখ্যা প্রায় ২০০,এর মধ্যে বেলুড় ও কোনা থেকে দু একটা শীতলা দেবী আসেন স্নানের উদ্দেশ্যে। কেবলমাত্র শালিখা কয়েল বাগানের কয়েলেশ্বরী শীতলা মা হচ্ছেন পাথরের মূর্তি। হরগঞ্জ বাজারের বড়শীতলা মা ও কয়েলেশ্বরী শীতলা মা স্বয়ম্ভূ দেবী ব’লে জানা যায়। এই শীতলা দেবীরা সাতবোন।এর মধ্যে সবচেয়ে বেশি জনপ্রিয় এবং শোভাযাত্রা যার হয়(প্রায় দু মাইলের অধিক শোভাযাত্রা),ইনি হচ্ছেন বড় শীতলা মা।এর মধ্যে উপেন্দ্রনাথ মিত্র লেনের শীতলা মা কখনও স্নানে বের হন না,যাকে সকলে ছোট মা বলে থাকেন। তাই অন্যান্য বোনেরা তার মন্দিরের কাছ দিয়ে ঘুরে যান।

বড় শীতলা মায়ের মূর্তিটি নিমগাছের কাঠে নির্মিত। আর ঐ কাঠ দান করেছিলেন সালকিয়া মড়াপোড়াঘাট শ্মশানের প্রতিষ্ঠাতা অক্ষয়কুমার ঘোষাল। তারজন্য আজও পর্যন্ত শীতলা মায়ের স্নানযাত্রার দিন বড় মায়ের শোভাযাত্রা হাওড়া রোড দিয়ে যখন যায় তখন শ্মশানের দিকে মায়ের মূর্তি একবার মুখ ঘুরিয়ে দেখানো হয়। এক বছর ভুলবশতঃ বা তাচ্ছিল্য হেতুও হতে পারে শ্মশানের দিকে মুখ করানো হয়নি। কিন্তু হঠাৎ বহনকারীরা অনুভব করলেন যে মূর্তি এত ভারী হল যে তাঁরা আর অগ্রসর হতে পারছেন। না। অবশেষে মায়ের মূর্তি শ্মশানের দিকে মুখ ঘোরালে সেই বোঝা আবার যেন বহনযোগ্য বলে মনে হ’ল। এ অভিজ্ঞতার কথা জানালেন শ্মশানের পুরোহিত গোবিন্দ চক্রবর্তী। শীতলা দেবী অতি অল্পেই সন্তুষ্ট হন। সামান্য বাতাসা, এক ঘটি জল ঢেলে রাস্তা ও মন্দির পরিষ্কার ক’রে পুজো দিলেই তিনি ভক্তের ওপর প্রীত থাকেন।

ধর্ম বিশ্বাসের কথা ছেড়ে দিলেও এই স্নানযাত্রা উৎসব যে বিভিন্ন ধর্মের ও জাতের এক মিলনতীর্থে পরিণত হয় যাতে সাম্প্রদায়িক হিংসা ও প্রাদেশিকতার দুষ্ট ক্ষত থেকে বিচ্ছিন্নতাবাদের বিরুদ্ধে এক নবভারত মুক্তি ও গঠনের কাজে তা সহায়ক হ’য়ে উঠে। বর্তমান বিধায়ক গৌতম চৌধুরী,যিনি নিজে বড় শীতলা দেবীর একনিষ্ট সেবক ও ভক্ত,তিনি নিজ উদ্যোগে ও তার দলের উদ্যোগে বিভিন্ন মন্দির তত্ত্বাবধান করছেন, এমনকি প্রশাসনের অধিকাংশ দায়ভার নিজ কাঁধে নিয়ে নিচ্ছেন। শুধু তাই এলাকায় এলাকায় তার উদ্যোগে ও অরিজিৎ বটব্যালের তত্ত্বাবধানে প্রতিটি উপবাসী করা ভক্তদের গামছা ও নতুন বস্ত্র প্রদান করছেন।

কলমে : সৌরভ সিংহ
যুগ্ম সম্পাদক, হাওড়া প্রেস ক্লাব

You may also like