মহানগর ডেস্ক: মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় বিজেপির বিরুদ্ধে বারবার অভিযোগ কর বলছেন, বিজেপি ধর্ম ও রাজনীতিকে এক করে ফেলছে। সিপিএম মতাদর্শগত ভাবে বিজেপি ও সংঘ পরিবারের বিরুদ্ধে ধর্মকে রাজনীতির সঙ্গে মিলিয়ে ফেলছে বলে প্রথম থেকেই অভিযোগ করে আসছে। অবশেষে ২০২৪-এর লোকসভা নির্বাচনের মুখে প্রচারে নেমে প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী পরিকল্পিতভাবে হিন্দু-মুসলমান, রাজা-মহারাজা, রাজা-বাদশা, ঔরঙ্গজেব-শিবাজিকে নিয়ে মেরুকরণের রাজনীতিতে নেমে পড়েছেন। আসলে বামেরা বরাবর বলে আসছে, মানুষের মৌলিক চাহিদা মেটাতে না পেরে কেন্দ্রের নরেন্দ্র মোদী সরকার মানুষের নজর ঘোরাতে অনেক আগে থেকেই ধর্মকে রাজনীতির উপাদান হিসাবে উপস্থাপিত করছে, পুরান আর ইতিহাস মিলিয়ে ফেলছে। বৈজ্ঞানিক ভিত্তির উপর নির্ভর করে দেশ পরিচালনার স্লোগান না দিয়ে, স্থায়ী উন্নয়নের পথে যাওয়ার স্লোগান না দিয়ে “রাম রাজত্ব” প্রতিষ্ঠার স্লোগান দিচ্ছেন নরেন্দ্র মোদী, অমিত শাহরা।
এবার এই মেরুকরণের রাজনীতিকে নতুন আঙ্গিকে নিয়ে এলেন প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী। লোকসভা নির্বাচনে প্রথম দফার ভোটদানের হার কম হওয়ার পর মেরুকরণকে প্রচারের কেন্দ্রবিন্দুতে নিয়ে এসেছিলেন মোদী। দ্বিতীয় দফাতেও ভোটদান পরিস্থিতির উন্নতি না হওয়ায় আজ কর্নাটকের ভোট প্রচারে হিন্দু-মুসলমান বিভাজনকে নতুন ভাবে সামনে এনে রাহুল গান্ধী তথা কংগ্রেসকে নিশানা করলেন ধর্মনিরপেক্ষ ভারতের প্রধানমন্ত্রী। সেই সঙ্গে আজ কর্নাটকের প্রতিটি জনসভার শেষে তাঁর আহ্বান, ‘‘গরম যতই হোক, আগে ভোটদান পরে জল পান।’’ তার মানে কি মোদী বলতে চাইছেন পিপাসায় ছাতি ফেটে মৃত্যু হলেও আগে মোদীর স্বার্থ সুরক্ষিত করে তারপর দেশবাসী নিজেদের প্রাণ বাঁচানোর জন্য জলপান করবেন? এ কোন সকাল এলো ভারতে? যে দেশের প্রধানমন্ত্রী দেশের মানুষকে প্রাণ বিপন্ন করে তাঁর দলের, তাঁর ব্যক্তিগত স্বার্থ রক্ষার আহ্বান জানাচ্ছেন?
মোদী কি বুঝতে পারছেন দুই দফার ভোট দেখে যে বিজেপির অবস্থা সুবিধাজনক নয়? না হলে কেন তিনি এতো আতঙ্কিত এই প্রশ্ন যখন কংগ্রেস তুলছে ঠিক সেই সময়েই নরেন্দ্র মোদী রাহুলকে ‘শাহজাদা’ বলে উল্লেখ করে বললেন, ‘‘স্বাধীনতার লড়াইয়ের সময়ে থেকে কংগ্রেস ভোটব্যাঙ্ক তোষণের খাতায় নাম লিখিয়েছে। কংগ্রেসের শাহজাদা সেই পাপকে আরও এগিয়ে নিয়ে যাচ্ছেন। তাঁর তাজা বয়ান, ভারতের রাজা মহারাজারা অত্যাচারী ছিলেন। তাঁরা নিজেদের মর্জিমাফিক গরিবের জমি ছিনিয়ে নিতেন। শাহজাদার এই বয়ান তোষণের বয়ান। কংগ্রেস এ কথা বলে শিবাজিকে অপমান করেছেন। ভেবে দেখুন, তিনি মহারাজাকে খারাপ বলছেন, অথচ নিজাম, বাদশা, সুলতানেরা ভারতবাসীর উপরে যে অত্যাচার করেছেন তা নিয়ে শাহজাদার মুখে তালা, কথা বন্ধ।’’ মোদীর বক্তব্য, ‘‘যে ঔরঙ্গজেব ভারতের মন্দির ধ্বংস করেছেন, অপবিত্র করেছেন, তাঁর কথা এক বারও শাহজাদার মনে পড়ে না। যারা ভারতে এসে লুট চালিয়েছে, গো হত্যা করেছে, ভারতের বিভাজনে বড় ভূমিকা নিয়েছে, তাদের মনে পড়ে না। কেউ ভাবতে পারেন, বারাণসীর রাজা ছাড়া সেখানে বেনারস হিন্দু ইউনিভার্সিটি হত? মহারানি অহল্যাবাঈ হোলকর মন্দির পুনর্নির্মাণ করে আমাদের বিশ্বাসকে রক্ষা করেছিলেন। বরোদার মহারাজ বাবাসাহেব অম্বেডকরের প্রতিভার পরিচয় পেয়ে তাঁকে বিদেশে পড়তে পাঠান। অথচ কংগ্রেসের শাহজাদার এ সব মনেই পড়ে না! নবাব সুলতানদের বিরুদ্ধে একটি শব্দও নেই তাঁর। এই তোষণের মানসিকতা কংগ্রেসের ইস্তাহারেও রয়েছে।’’
প্রকৃতপক্ষে রাহুল তাঁর প্রচারে বলেছেন, ‘‘আগে রাজা মহারাজার শাসনে তাঁরা যা চাইতেন তাই করতেন। জমি জায়গার দরকার হলে মানুষের কাছ থেকে তা হরণ করে নিতেন। কংগ্রেস দেশবাসীর সঙ্গে মিলে দেশকে স্বাধীনতা দিয়েছে, গণতন্ত্র এনেছে, সংবিধান উপহার দিয়েছে।”
আজ মোদীর এই আক্রমণের পরে এআইসিসি-র নেতা মানিকম টেগোর সাম্প্রতিক বাজেট অধিবেশনের একটি ক্লিপ তুলে পোস্ট করেছেন তাঁর সমাজমাধ্যমে যেখানে মোদীকে বলতে শোনা যাচ্ছে, ‘‘এই সংসদে আজ ইংরেজদের কথা বলা হয়েছে। রাজা মহারাজাদের তো এক সময়ে ইংরেজদের সঙ্গে গভীর সম্পর্ক ছিল।’’
কংগ্রেসের বক্তব্য, মোদী যে রাজা-মহারাজাদের বিরুদ্ধে ইংরেজ-ঘনিষ্ঠতার সমালোচনা করেছিলেন, এখন সেই রাজা-মহারাজাদেরই প্রশংসা করছেন। তকটা হাস্যকর, অযৌক্তিক, ভোটমুখি রাজনীতি করছেন মোদী এটা দেশের মানুষ বুঝতে পারছেন।
উত্তরপ্রদেশ, গুজরাত, রাজস্থানের মতো রাজ্যগুলিতে রাজপুত সম্প্রদায়ের বিজেপি-বিরোধী ক্ষোভের দিকটিকেও সামনে নিয়ে এসেছেন মানিকম। মহারাজাদের বিরুদ্ধে মোদীর পুরনো আক্রমণকে হাতিয়ার করে মানিকম লিখেছেন, “মোদীর উচিত রাজপুত সম্প্রদায়ের কাছে অবিলম্বে ক্ষমা চাওয়া তাঁদের বিরুদ্ধে এই অপমানজনক মন্তব্যের জন্য”। কংগ্রেস নেতা জয়রাম রমেশ বলেছেন, ‘‘প্রধানমন্ত্রী মোদী জঘন্যতম স্তরে পৌঁছেছেন। রাহুল গান্ধীর প্রতিটি মন্তব্যকে বিকৃত করে তিনি সাম্প্রদায়িক আবেগে উস্কানি দিতে চাইছেন। প্রস্থান অবশ্যম্ভাবী বুঝেই মোদী আরও মরিয়া হয়ে উঠেছেন।’’
গত কয়েক দিনের প্রচারের মতো মেরুকরণের অন্য সংলাপগুলিকেও আজও ব্যবহার করতে দেখা গিয়েছে মোদীকে। তুলেছেন ‘এক্স রে’ এবং ‘উত্তরাধিকার করের’ প্রসঙ্গ। কর্নাটকবাসীকে সাবধান করার ঢঙে বলেছেন, ‘‘কংগ্রেসের শাহজাদা ও তাঁর বোন দু’জনেই ঘোষণা করেছেন কংগ্রেস জিতলে দেশের মানুষের জমানো সম্পদ, গাড়ি, স্কুটার, স্ত্রীধন, মঙ্গলসূত্র, সোনা সব কিছুতে এক্স রে হবে। ঘরে ঘরে এক্স রে করে তারা সম্পদ লুট করতে চায়। সেই সম্পদ বণ্টন করবে পছন্দের ভোটব্যাঙ্ককে। আপনারা কি কংগ্রেসকে নিজেদের সম্পদ লুটতে দেবেন? কংগ্রসকে সতর্ক করতে চাই, মোদী যত দিন বেঁচে আছে, আপনাদের এই মনস্কামনা পূরণ হবে না।’’
কংগ্রেস নেতা স্যাম পিত্রোদার উত্তরাধিকার কর সংক্রান্ত মন্তব্যটির পরে যে বিতর্ক তৈরি হয়েছে তাকে আরও উস্কে দিয়ে প্রধানমন্ত্রী বলেছেন, ‘‘উত্তরাধিকার করের কথা শুনলে আপনাদের ঘুম চলে যাবে। দিল্লিতে কংগ্রেসের সরকার এলে এমন আইন তারা আনবে তাতে আপনার গোটা জীবনের জমানো সঞ্চয়ের ৫৫ শতাংশ সরকার ছিনিয়ে নেবে। সব বাবা মা-ই চান তাঁর সন্তানের জন্য কিছু রেখে যেতে, যাতে তাকে কারও কাছে হাত না পাততে হয়। কিন্তু কংগ্রেস চায় তাদের ভোটব্যাঙ্কের কাছেই দেশের সম্পদ যাক।’’
কংগ্রেসের পাল্টা বক্তব্য, “নরেন্দ্র মোদী দেশের মানুষের নাগরিকত্ব কেড়ে নিতে চাইছেন। রাষ্ট্রায়ত্ত সংস্থাগুলো একের পর এক বিক্রি করে দিচ্ছেন, ব্যাঙ্ক, বিমা, রেলের মতো লাভজনক সংস্থাকে বেসরকারি হাতে পুরোপুরি তুলে দিতে চাইছে। এছাড়াও এক দেশ, এক ভেট, এক পতাকা চালু করে দেশের ধর্মনিরপেক্ষ, গণতান্ত্রিক, সার্বভৌমত্ব নষ্ট করার উদ্যোগ নিয়েছে। চলতে ফিরতে মোদী অনুপ্রবেশকারী দেখছেন। এমন ভাব যেন বিজেপিই একা দেশপ্রেমী, দেশের সব মানুষ দেশদ্রোহী। স্বাধীনতার সময় সংঘ পরিবার ব্রিটিশদের দালালি করেছে, স্বাধীনতা সংগ্রামীদের সঙ্গে বিশ্বাসঘাতকতা করেছে, জাতির জনক মহাত্মা গান্ধীকে হত্যা করেছে, এখন সেই নরেন্দ্র মোদী ও তাঁর দল দেশপ্রেমীর ভেক ধরে নাটক করছেন।”
ধমনিরপেক্ষ দেশের প্রধানমন্ত্রী কি ভাবে রাম মন্দির উদ্বোধন করেন? দেশটাকি শুধু হিন্দুদের? এই প্রশ্নও তুলেছেন বাম, কংগ্রেস সহ সমস্ত প্রগতিশীল, গণতান্ত্রিক ব্যক্তিত্ব। তাঁদের মতে নরেন্দ্র মোদী সংবিধান ধ্বংসের খেলায় মেতেছেন, এই প্রয়াস দেশের সার্বভৌমত্ব রক্ষার ক্ষেত্রে বিপজ্জনক।