মহানগর ডেস্ক : শুক্রবারই তৃণমূলের রাজ্য সাধারণ সম্পাদক ও মুখপাত্র পদ থেকে কুণাল ঘোষ ইস্তফা দিয়েছেন। শনিবার মুখপাত্র পদে কুণালের ইস্তফা গ্রহণ করেছে তৃণমূলের শীর্ষ নেতৃত্ব। রবিবার দল কুণালের বিরুদ্ধে আরও একধাপ এগিয়ে তাঁকে শোকজের নোটিস পাঠাতে চলেছে বলে তৃণমূল সূত্রে খবর।
দলের রাজ্য সাধারণ সম্পাদক ও মুখপাত্র পদে ইস্তফা দেওয়ার পর থেকে কুণাল ঘোষ লাগাম ছাড়া ভাবে সুদীপ বন্দ্যোপাধ্যায়ের বিরুদ্ধে সামাজিক মাধ্যমে পোস্ট করে চলেছেন বা সংবাদমাধ্যমে কথা বলে চলেছেন। শনিবার সন্ধ্যাতে কুণাল এক্স হ্যান্ডলে লিখেছেন, ‘‘আমি তৃণমূলের রাজ্য কমিটির অন্যতম সাধারণ সম্পাদক ও মুখপাত্রের পদ থেকে ইস্তফা দিয়েছিলাম। খবর পেয়েছি, শুধু মুখপাত্র থেকে ইস্তফার অংশটি গ্রহণ করা হয়েছে। দলের কাছে আমার সবিনয় অনুরোধ, সাধারণ সম্পাদক পদ থেকে ইস্তফাটিও গ্রহণ করা হোক। আমি ওই পদে থাকব না। আমি শুধু কর্মী হিসেবে থাকব।’’ কুণাল আরও বলেছেন, ‘‘আমার কোনও মান-অভিমান নেই। আমি জীবনে উত্থান-পতন, স্বর্গ-নরক দেখেছি। তাই আমি সব কিছুকে স্বচ্ছ ভাবে দেখতে চাই। সেটাই হয়ে যায় মুশকিল।’’
তবে সুদীপ বন্দ্যোপাধ্যায় লোকসভায় তৃণমূলের পরিষদীয় দলনেতা। তিনি যা করেন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়, অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায় তার সবটাই জানেন। কাজেই কুণাল ঘোষ এবং শনিবার বরানগরের বিধায়ক তাপস রায়ের সুদীপ বন্দ্যোপাধ্যায়কে বিজেপির হয়ে কাজ করেন এবং নরেন্দ্র মোদীর ঘনিষ্ঠ বলে সো তীব্র আক্রমণ করেছেন সেই আক্রমণের লক্ষ্য কিন্তু মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় এবং অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায়ও হয়ে যান। এটা না বুঝে কুণাল এবং তাপস সোশ্যাল মিডিয়ায় এবং সংবাদ মাধ্যমে মুখ যে খোলেননি সেটা সহজেই অনুমেয়। আর তাই সম্ভবত এবার কুণালকে শোকজের নোটিশ ধরাতে চলেছে তৃণমূল। তবে তাপস রায় সুদীপ বন্দ্যোপাধ্যায় সম্পর্কে কিছুই বলতে বাকি রাখেননি, এমন কি তিনি এটাও বলেছেন, তাঁর বাড়িতে ইডি সুদীপ বন্দ্যোপাধ্যায়ই পাঠিয়েছেন। দলে এই নিয়ে তিনি অনেক বলেছেন, আর কাউকে বলার প্রয়োজন বোধ করছেন না। তৃণমূল সূত্রের জানা গিয়েছে, এখন তাপস রায়কে তেমন কিছু দল বলতে চাইছে না। তবে কুণাল যে ভাবে ধারাবাহিক দলের প্রবীণ সাংসদ সুদীপ বন্দ্যোপাধ্যায়কে আক্রমণ এমন কি গ্রেফতারের জন্যও ইডি, সিবিআইকে উদ্দেশ্য করে তাঁর এক্স হ্যান্ডেলে আবেদন জানিয়েছেন, এই বিষয়টি ভালো ভাবে নেয়নি তৃণমূল শীর্ষনেতৃত্ব।
তৃণমূলের এক শীর্ষ নেতা, যিনি নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক, তিনি বলেছেন, ‘‘দলের বিভিন্ন বিষয় নিয়ে অনেকের ক্ষোভ-বিক্ষোভ থাকতেই পারে। কিন্তু সেটা দলের মধ্যেই বলা উচিত। যে ভাবে কুণাল ঘোষ লাগাতার সুদীপ বন্দ্যোপাধ্যায় সম্পর্কে বিস্ফোরক অভিযোগ করছেন, তা আর যা-ই হোক, দলকে লোকসভা নির্বাচনের মুখে সাহায্য করছে না।’’ তৃণমূলে এই প্রবীণ নেতার ক্ষোভ, ‘‘দল সুদীপ বন্দ্যোপাধ্যায়ের সম্পর্কে ওঁর বক্তব্য সমর্থন করে না।’’ দলের এই প্রবীন সাংসদ সুদীপ বন্দি অবস্থায় ভুবনেশ্বরের একটি বেসরকারি হাসপাতালে চিকিৎসাধীন থাকার সময় তাঁর বিল ইত্যাদি নিয়ে প্রকাশ্যে প্রশ্ন তুলে তাঁর বিরুদ্ধে তদন্তের দাবি তুলেছেন কুণাল ঘোষ, এমন কি সুদীপের গ্রেফতারির দাবিও জানিয়েছেন, দল কুণালের এই অভিযোগ ভালো ভাবপ দেখছে না। কুণাল তাঁর এক্স হ্যান্ডলে ওই বিষয়ে তদন্তের দাবি জানিয়েছেন। দাবি জানিয়েছেন সুদীপের পুনরায় গ্রেফতারিরও। কিন্তু দলের অন্দরে কুণালের বিরোধীরা আরও একটি বিষয় উল্লেখ করছেন। তাঁদের বক্তব্য, কুণাল যে ভাবে ওই পোস্টে এনফোর্সমেন্ট ডিরেক্টরেটের ডিরেক্টর এবং সিবিআইকে ‘ট্যাগ’ করেছেন, তা ‘দলবিরোধী’। এদিকে কুণাল ঘোষের এই কাজকর্ম সম্পর্কে ফিরহাদ হাকিমকে প্রশ্ন করা হলে তিনি বলেন, “আমি এই বিষয়ে কিছু বলবো না, বললে আর একটা বিস্ফোরণ হয়ে যাবে।”
কুণালের এই পদক্ষেপ তৃণমূল নেত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় এবং দলের সর্বভারতীশ সাধারণ সম্পাদক অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায়ের দল পরিচালনা নিয়ে প্রশ্ন তুলে দিচ্ছে বলে তৃণমূলের শীর্ষনেতৃত্ব মনে করছে এবং এই কারণেই তাঁরা কুণাল ঘোষের এই জাতীয় আচরণে অযন্ত ক্ষুব্ধ। দলের শীর্ষ নেতৃত্ব মনে করে, এই ধরনের প্রবণতা অনেক সময়েই ‘সংক্রামক’ হয়ে দলের সর্বনাশ ডেকে আানে। লোকসভা ভোটের আগে এ সব ছড়াতে শুরু করলে তা তৃণমূলের পক্ষে আদৌ ভালো হবে না। তাই সময় নষ্ট না-করে মুখপাত্রের পদে কুণাল ঘোষের ইস্তফা গ্রহণ করে নিয়েছে দল। ওই পদক্ষেপের মাধ্যমে কুণালকে প্রয়োজনীয় এবং প্রাথমিক বার্তাও দল দিয়েছে। কিন্তু তার পড়েও কুণাল না থামায় এ বার কুণালকে শোকজের সিদ্ধান্ত নেওয়ার পথেই যাচ্ছে দল।
তবে কুণাল ঘোষ এবং তাপস রায়ের সুদীপ বন্দ্যোপাধ্যায়ের বিরুদ্ধে এই আচরণ আজকের নতুন ঘটনা নয়। তবে সম্প্রতি কএণাল এবং তাপস সুদীপ বন্দ্যোপাধ্যায়ের বিরুদ্ধে আক্রমণের ঝাঁজ বাড়িয়েছেন। কুণাল এর আগে দলের সব সুবিধা নিয়ে বিজেপির বিরুদ্ধে তীব্র আক্রমণ করেন না বলে তৃণমূলের মুখপাত্র ও বেশ কিছু নেতার বিরুদ্ধে সরব হয়েছিলেন। তখন কুণালের সমালোচনা থেকে বাদ যাননি দলের শুরুর থেকে দলের দায়িত্বে থাকা প্রাক্তন সর্বভারতীয় সাধারণ সম্পাদক এবং বর্তমান রাজ্য সম্পাদক সুব্রত বক্সী। এবারও পূর্ব মেদিনীপুর জেলার ঘাটাল ও তমলুকে জনগর্জন সভার প্রস্তুতি বৈঠক সুব্রত বক্সী কেন পরিচালনা করেছেন, কেন কুণালকে সেই বৈঠকে ডাকা হয়নি, তিনি পূর্ব মেদিনীপুর জেলার দায়িত্বপ্রাপ্ত নেতা হওয়ার পরেও,সেটাও কুণালের ক্ষোভের অন্যতম কারণ।
তবে কুণাল যা করছেন তা তৃণমূলের নবীন – প্রবীণ সংঘাত উস্কে দেওয়ার জন্য দলীয় কারও নির্দেশ কি না তা নিয়েও দলের মধ্যে প্রবীণদের সন্দেহ আছে। তবে যাই হোক প্রকাশ্যে কুণাল ঘোষের এ ভাবে সুদীপের বিরুদ্ধে বলা যে মমতা ও অভিষেকের নেতৃত্বকেই চ্যালেঞ্জ করা সেটা বুঝতে তৃণমূল নেতৃত্বের অসুবিধা সম্ভবত হচ্ছে না, আর তাই আজ, রবিবারই কুণাল ঘোষকে শোকজ করতে চলেছে তৃণমূল শীর্ষ নেতৃত্ব। তবে পরিস্থিতি যে খুব স্বাভাবিক নয় সেটা বোঝা যাচ্ছে।